শিশু স্বাস্থ্য

নিচের বিষয়গুলো যদি ঠিক থাকে তবে ধরে নেয়া যায় শিশুটি ঠিকমতো বেড়ে উঠছে।

শিশুর ওজন নিয়মিত বাড়ছে কিনা 
৩ মাসে শিশুর ঘাড় শক্ত হয়েছে কিনা 
৬ মাসে শিশু বসতে পারছে কিনা 
৮ মাসে শিশু হামাগুড়ি দিচ্ছে কিনা 
৯-১০ মাসে শিশু কোনো কিছু ধরে হলেও দাঁড়াতে পারে কিনা 
১ বছরে হাঁটতে পারে কিনা। 
১ বছরে মা-বাবা এরকম কিছু সহজ শব্দ বলা শিখলো কিনা 
শিশু ঠিকমত কানে শুনছে কিনা 
শিশু ঠিকমত চোখে দেখছে কিনা 
*-* দৈনিক কালের কন্ঠ *-*




শিশুর খাদ্যাভাস
শিশুর স্বাস্থ্য সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে মা-বাবার উপর। কিন্তু শিশুকে ভালভাবে খাওয়ানো বেশিরভাগ মায়ের কাছে একটা সমস্যা। কারন খিদে পেলে শিশুরা বলতে পারে না। খাওয়াটা তার জন্য যথেষ্ট হয়েছে কিনা, তার তৃপ্তি হল কিনা সেটা শিশু সরাসরি বোঝাতে পারেনা। তাই অনেক সময় বিশেষ করে নতুন মায়েদের জন্য শিশুকে ভালভাবে খাওয়ানো একটা সমস্যা। আমাদের দেশের মায়েদের এ বিষয়ে শিক্ষা দেবার কোন বিধিবদ্ধ নিয়ম নেই। শুধু মা-দাদিদের অভিজ্ঞতালব্ধ পরামর্শ একমাত্র সম্বল। অথচ তাদের পরামর্শ অনেক ক্ষেত্রেই কুসংস্কার ও অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণায় পরিপূর্ণ। সেইজন্য অনেক সময় এসব পরামর্শে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই হয় বেশি। উল্লেখ্য যে নানাবিধ অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও কুসংস্কার আমদের দেশে শিশু মৃত্যুর উচ্চহার ও শিশুদের ব্যাপক অপুষ্টির প্রধানতম কারন।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে অনেক শিশুকে মায়ের প্রথম দুধ কোলস্ট্রাম দেয়া হয় না। এটা একটা কুসংস্কার ও অজ্ঞতা। অথচ মায়ের প্রথম দুধ (যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় শালদুধ) শিশুদের জন্য অত্যান্ত প্রয়োজনীয়। এতে রয়েছে নানাধরনের মারাত্মক রোগ প্রতিরোধক উপাদান। জন্ম থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুর জন্য মায়ের দুধই যথেষ্ট। এ বয়সে শিশুর যে পরিমাণ পুষ্টির প্রয়োজন মায়ের দুধে তা সব রয়েছে। শিশুর বয়স ছয় মাসের বেশি হলে তার পুষ্টি চাহিদা বেড়ে যায়। তখন শুধু মায়ের দুধে পুষ্টি চাহিদা মেটেনা। তাই মায়ের দুধের সাথে পরিপূরক বা আলগা খাবার দেয়ার প্রয়োজন হয়। শিশুকে পরিপূরক খাবার ভালভাবে খাওয়াতে হলে, শিশুকে বোঝা প্রয়োজন। শিশুর মনমানসিকতা, দৈহিক ক্ষমতা, পাকস্থলীর আকার, শিশুর পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি সম্বন্ধে জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারন এসবের সাথে শিশুর খাওয়াদাওয়া সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো শিশুকে খাওয়ানের পূর্বে আদর করে উৎফুল্ল করে তুলতে হবে। খাবারটা শিশুর সামনে তৈরি করলে অনেক সময় খাবার প্রতি শিশুর আগ্রহ বাড়ে। খাবার তৈরি হতে হতে থাকলে শিশু মানসিকভাবে খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে ও ধীরে ধীরে খাওয়ার জন্য এগিয়ে আসে। খাওয়ার সময় শিশুর সাথে অনবরত কথা বলতে হবে। বিভিন্ন ধরনের আদর সূচক কথা শিশুকে খাওয়ার দিকে মনযোগী করে। শিশুকে খাওয়ানোর সময় মায়েদের খেয়াল করতে হবে শিশুর পাকস্থলীর আকারের প্রতি, যেন জোর করে শিশুকে অতিরিক্ত না খাওয়ানো হয়। অতিরিক্ত খাওয়ালে পুরো খাবারটাই বমি করে ফেলে দিবে। তাই পরিমাণ ঠিক রেখে শিশুকে বারবার খাওয়াতে হবে।

নিম্নে পরিপূরক খাবারের কয়েকটা গুনাগুণ আলোচনা করা হল-
১। শিশুর পরিপূরক খাবার হওয়া উচিত সুষম। অর্থাৎ শিশুর চাহিদা অনুসারে আমিষ, খাদ্যশক্তি, ভিটামিন, মিনারেল যথেষ্ট পরিমাণে খাওয়া উচিত।
২। পরিপূরক খাবার হতে হবে পুষ্টি ঘন। কারন শিশুর পাকস্থলী থাকে ছোট। তাই স্বল্প পরিমাণে খাবার যেন শিশুর পুষ্টি চাহিদা মেটে সেদিকে নজর রাখতে হবে।
৩। শিশুর পরিপূরক খাবার হওয়া উচিত নরম। শক্ত ও শুকনো খাবার শিশুরা খেতে পারে না। 
৪। শিশুর খাবার হওয়া উচিত যেকোনো ধরনের মসলা-বিহীন এবং একটু মিষ্টিস্বাদযুক্ত। 
৫। সবসময় শিশুর পরিপূরক খাওয়া উচিত তাজা। একবেলার রান্না খাবার অন্য বেলা খাওয়ানো উচিত না। বাসি খাবার খেলে শিশুর পেটের অসুখ হতে পারে।

“১৯৭৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট জাতিসংঘে্র শিশু তহবিলের সহযোগিতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন বয়সের শিশুদের জন্য কয়েকটি পরিপূরক খাবারের ফরমুলা তৈরি করেন। নিম্নে সেসব খাদ্যের বর্ণনা দেয়া হলঃ

১। ৬ থেকে ১২ মাস বয়সী শিশুদেরকে মায়ের দুধের সাথে পরিপূরক খাবার হিসাবে খাওয়াতে হবেঃ
নরম ভাতঃ ৩/৪ ছটাক চাউলের 
রুটি দুধে ভিজিয়েঃ টেবিল চামচে প্রায় ২১/২ চামচ 
ভাত নরম করে খিচুড়িঃ ২ চায়ের চামচ 
আলু চটকিয়েঃ ছোট একটা 
শাকপাতা ও অন্যান্য সবজি ভাতের সাথেঃ ১ ছটাক 
কলা/ছোট একটা ডিম(সামর্থ্য থাকলে): ১ টা 

২। ১-৩ বছর বয়সের বাচ্চাদের খাদ্য তালিকাঃ
ভাত, পিঠা, মুড়ি, চিড়াঃ ১৩/৪ ছটাক চাউলের 
রুটি, বিস্কিটঃ ১ ছটাক আটার 
ডালঃ (মাঝে মাঝে ডাল ও চালের খিচুড়ি, হাতের ১ থেকে ১১/২ মুষ্টি) নিরামিষ বা ভাজি (সাক,আলু, মিষ্টি কুমড়া, গাজর, তেল ইত্যাদি)ঃ ১ ছটাক শাঁক, ১/২ ছটাক সবজি, ১ ছটাক আলু, গাজর, ২ চা চামচ তেল 
মাছ মাংসের তরকারিঃ ১/৪ ছটাক সবজি, ৩/৪ ছটাক মুলা, ১/২ ছটাক মাছ বা মাংস, 
২ চা চামচ দুধ-ভাত, পায়েসঃ ২ ছটাক 
দুধ, দুধ-রুটি, সুজি রান্নাঃ ১/২ ছটাক চিনি বা গুড় 
যে কোন ফলঃ একটা 

৩। ৪-৬ বছর বয়সের বাচ্চাদের খাদ্য তালিকাঃ
ভাত, পিঠা, সুজি, মুড়ি, চিড়াঃ ২১/২ ছটাক চাউলের রুটি, 
বিস্কিট, সুজিঃ ১ ছটাক গমের 
ডালঃ ৩/৪ ছটাক (মাঝে মাঝে ডাল ও চালের খিচুড়ি) 
নিরামিষ বা ভাজিঃ ১ ছটাক শাঁক, ৩/৪ ছটাক সবজি, ১ ছটাক আলু, গাজর;২ চা চামচ তেল 
মাছ মাংসের তরকারিঃ ১/২ ছটাক সবজি, ১ ছটাক আলু, ১/২ ছটাক মাছ বা মাংস, 
২ চা চামচ দুধ-ভাত, পায়েসঃ ২ ছটাক 
দুধ, দুধ-রুটি, সুজি রান্নাঃ ১/২ ছটাক চিনি বা গুড় 
যে কোন ফলঃ একটা 

*-*তথ্যসূত্রঃ মা ও শিশুর পুষ্টি- ডঃ মুহম্মদ কবিরউল্ল্যা*-*

বিদ্রঃ  ১। রেফারেন্স বা তথ্যসুত্রবিহীন কোন লেখা পড়ে আপনার শিশুর স্বাস্থ্য ঝুকিতে ফেলবেন না।
২। ধৈর্য ধরে লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

শিশুর সকালের নাস্তা 
সকালের নাশতা নাকি সারা দিনের পুষ্টির জোগান দেয়। অনেক শিশু সকালে খেতেও চায় না। এ বিড়ম্বনা থেকে রেহাই দিতেই সকালে শিশুর নাশতা কী ধরনের হতে পারে জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. খালেদা ইসলাম।

বয়স যখন তিন থেকে পাঁচ
এ বয়সের বাচ্চারা সকালে সাধারণত দুধ খেয়েই স্কুলে যায়। তবে পুষ্টির কথা চিন্তা করলে রেসিপি-১ খেতে পারে।

রেসিপি-১
কর্নফ্লেক্স+দুধ+চিনি 
একটা মৌসুমি ফল_কলা, পাকা পেঁপে, কমলা বা আপেল। বা 
লাল আটার রুটি+ডিম+ভাজি/ডাল চচ্চড়ি, সঙ্গে যেকোনো একটি ফল। 

বয়স যখন পাঁচ থেকে ১২
পাঁচ থেকে ১২ বছরের শিশুর ক্ষেত্রে নাশতাটা একটু ভারী হতে হবে। অনেক শিশু সকালে খিচুড়ি খেতে চায় না, তারা লাল আটার রুটি দুটি খেতে পারে।
বা রুটি দুটি+ডিম+ভাজি/ডাল চচ্চড়ি+একটি ফল অথবা

রেসিপি-২
খিচুড়ি+ডিম ভাজি/ডাল+একটি ফল। 
টিফিন 
টিফিনে শিশুরা মজার কিছু খেতে চায়। লাল আটার রুটি+চিকেন ফ্রাই+ফল 
অথবা 
বাটার দেওয়া বনরুটি+ডিম সেদ্ধ+ফল। 

টিপস
শিশুদের নাশতায় বৈচিত্র্য আনতে চেষ্টা করুন। 
টিফিন খাওয়ার ক্ষেত্রে হাত ধুয়ে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। 
অনেক বাচ্চাই সকালে নাশতা করতে চায় না। জোর করে হলেও বাচ্চার নাশতা খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। 

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় পিতা-মাতার ভূমিকা
আমাদের দেশে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি সরকার ও জনগণের কাছে এখনো উপেক্ষিত। শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি মানুষ যতটা সচেতন মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি ঠিক ততটা সচেতন নন। মানসিক স্বাস্থ্যকে বাদ দিয়ে একজন মানুষ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারে না, কেননা শরীর ও মন একে অপরের সাথে জড়িত। তাই শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য মনোবিজ্ঞানী, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান সাইকিয়াট্রিস্ট, এনজিও, সরকার ও সচেতন জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আসতে হবে।

আমরা যেমন মাঝে মাঝে শারীরিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হই, ঠিক তেমনি মাঝে মাঝে মানসিক অসুস্থতাতেও আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারি। শরীরের কোনো অংশে কার্যক্রম যদি সঠিকভাবে সম্পাদিত না হয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাহলে আমাদের শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয়। অন্যদিকে পরিবেশের বিভিন্ন উদ্দীপকের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে আমাদের মন কখনো কখনো উৎফুল্ল এবং কখনো কখনো বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই সব সময় মানসিক দিক দিয়ে পুরোপুরি সুস্থ মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পন্ন যে সব বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয় সেগুলো হলো :

১) পরিবেশে অভিযোজন ক্ষমতা : মানসিক দিক থেকে সুস্থ ব্যক্তির পরিবেশ সব সময় অনুকূলে না হলেও সে তার মানসিক ভারসাম্য হারায় না। প্রচন্ড প্রতিকূল পরিবেশেও তার মানসিক ভারসাম্য বজায় থাকে।

২) প্রয়োজনীয় শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ : আমরা জানি শরীর ভালো না থাকলে মনও ভালো থাকে না তাই মানসিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে শারীরিক স্বাস্থ্য অবশ্যই ভালো থাকা আবশ্যক। অন্যদিকে চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে কঠিকভাবে খাপখাইয়ে চলার জন্য চিন্তা করার ক্ষমতা, যুক্তি প্রয়োগ ও বিচার করার ক্ষমতা থাকা আবশ্যক। তাই বলা যায় যে, মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য যথাযথ বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ প্রয়োজন। 

৩) অটুট আত্মবিশ্বাস : মানসিক দিক দিয়ে স্বাস্থ্যসম্পন্ন ব্যক্তি কখনো তার আত্মবিশ্বাস হারায় না। প্রচ- প্রতিকূল ও সমস্যাসঙ্কুল পরিবেশেও সে পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে তার কার্যক্রম চালিয়ে যায়।

৪) পরিপূর্ব আত্মতুষ্টি : মানসিক দিক দিয়ে সুস্থ ব্যক্তির আচরণে সব সময় আত্মতৃপ্তির পরিচয় পাওয়া যায় পক্ষান্তরে মানসকি দিক থেকে অসুস্থ ও মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির মেজাজ সব সময় খিটখিটে প্রকৃতির হয়ে থাকে।

৫) প্রয়োজনীয় আবেগীয় ও সামাজিক বিকাশ : মানসিক দিক থেকে সুস্থ ব্যক্তির আবেগীয় বিকাশ ও প্রকাশ স্বাভাবিক হয়ে থাকে। বিশেষ কারণ থাকলেও তিনি সামাজিক পরিবেশে রাগান্বিত বা উত্তেজিত হয়ে পড়েন না। মানসিক দিক দিয়ে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সমাজের প্রত্যাশা অনুযায়ী কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। 

৬) নিজের চাহিদা সম্পর্কে সচেতনতা এবং সে অনুযায়ী কাজ করার ক্ষমতা : মানসিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী তার চাহিদা মাত্রা সম্পর্কে সব সময় সচেতন থাকেন এবং সব চাহিদা তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার মধ্যে থাকে। অবাস্তব চাহিদার বাড়িয়ে তিনি অসুখী হতে চায় না।

৭) উপযুক্ত অনুরাগ ও মনোভাবের বিকাশ : মানসিক স্বাস্থ্যসম্পন্ন ব্যক্তির কাজের মধ্যে যথাযথ অনুরাগ ও অনুকূল মনোভাব দেখা যায় পক্ষান্তরে যাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে না তারা সামাজিক পরিবেশ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়।

৮) মানসিক দিক দিয়ে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সব সময় নিজেকে সুখী, সক্ষম ও আশাবাদী মনে করে। 

প্রফেসর নীহার রঞ্জন সরকারের মতে, 'কোনো ব্যক্তি যদি সমাজ স্বীকৃত উপায়ে তার চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে, সমাজে কার্যকরী এবং উপযোগী ভূমিকা পালন করতে পারে এবং নিজেকে সুখী, সক্ষম ও সফল ব্যক্তি হিসেবে মনে করে, তাহলে তাকে মানসিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বলা যায়।'

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের ক্রোড়পত্র (২০১১) থেকে জানা যায়, প্রাপ্ত বয়স্ক ১৮ বছর ও তদুর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর ১৬.১% মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় (মানসিক রোগে) আক্রান্ত। এদের মধ্যে নিউরোটিক ডিসঅর্ডার ৮.৪%, বিষণ্নতা ৪.৬% ও সাইকোটিক ডিসঅর্ডার ১.১%। শিশু মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ঢাকা বিভাগে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় শতকরা ১৮.৪% শিশু মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ভুগছে। এছাড়াও শিশুদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, মৃগী রোগ ও মাদকাসক্তির শতকরা হার যথাক্রমে ৩.৮, ২.০ ও ০.৮ ভাগ। উক্ত ক্রোড়পত্র অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম রব্বানী তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় কর্মরত জনবল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। প্রতি লাখ জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মরত জনবল ০.৪৯ জন এর মধ্যে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ প্রতি লাভ জনগোষ্ঠীতে ০.০৭ জন যা নিতান্তই অপ্রতুল। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য "উবঢ়ৎবংংরড়হ : অ এষড়নধষ ঈৎরংরং" বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত গবেষণাতে বলা হয়েছে ুএষড়নধষ নধৎফবহ ড়ভ ফরংবধংবংচ্ এর মধ্যে বিষণ্নতার অবস্থান চতুর্থ। বিষণ্নতার মর্মান্তিক পরিণাম হলো আত্মহত্যা। তীব্র মাত্রার বিষণ্নতা ব্যতীত সাধারণ বিষণ্নতা চিকিৎসার জন্য সাইকোথ্যারাপি হচ্ছে সর্বোত্তম ব্যবস্থা। 

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় মা-বাবা ও শিক্ষকবৃন্দের ভূমিকা :
শিশুর মৌলিক চাহিদাগুলো অতৃপ্ত থাকার জন্য তার মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষুণ্ন হয়। তাই তার স্বাধীনতার চাহিদা, আত্মস্বীকৃতির চাহিদা সক্রিয়তার চাহিদা নিরাপত্তায় চাহিদা প্রভৃতি যাতে তার বাসগৃহ এবং বিদ্যালয়ে পূরণ করার সুযোগ পায় সে দিকে লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। মনোবিজ্ঞানীদের মনে করেন বাসগৃহ এবং বিদ্যালয়ের পরিবেশ মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য অনুকূল হওয়া প্রয়োজন। বিদ্যালয়ের পরিবেশ সুন্দর ও স্বাস্থ্যসম্মত হলো, শিক্ষকবৃন্দও শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও বিকাশে সচেষ্ট হলেন, অথচ বাসগৃহে মা-বাবা এ ব্যাপারে সচেতন থাকলেন না, তাহলে শিশুর সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশ ঘটবে না। শিক্ষক এবং অভিভাবকবৃন্দের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া কোনোভাবেই শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা সম্ভব নয়। সমাজ মনোবিজ্ঞানী র‌্যাডকি মা-বাবার আচরণের সঙ্গে শিশুদের ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও পর্যালোচনা চালিয়েছেন। তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্য নিম্নরূপ :

মা-বাবার আচরণ শিশুর ব্যক্তিত্বে প্রতিক্রিয়া
প্রত্যাখ্যান আগ্রাসন, অসহায়বোধ ও ভীতি অতি সংরক্ষণ শিশুসুলভ আচরণ, বশ্যতা, অসহায়বোধ ও উদ্বেগ নমনীয়তা ও অনুমোদনশীলতা আগ্রাসন, হঠকারিতা ও অবাধ্যতা 
অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ আগ্রাসন, ঈর্ষা ও অপরাধ প্রবণতা
মা-বাবার উপরোক্ত আচরণ শিশু মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
আর যেসব পরিবারের মা-বাবা শিশুদের সঙ্গ দেন, আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করেন এ সমস্ত শিশুরা পরবর্তীকালে আত্মবিশ্বাসী হয়ে অন্যদের সাথে সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও ভালো থাকে। শিশুর প্রতি মা-বাবার আচরণের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম যদি কঠিন হয়, শ্রেণী কক্ষে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হয়, বিদ্যালয়ের পরিবেশ যদি সুশৃঙ্খল না হয় তাহলেও এ সব বিষয় শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষুণ্ন করতে পারে।

একজন শিক্ষক সহজেই লাজুক, নিঃসঙ্গ বা আত্মবিশ্বাসহীন শিশুকে সাহায্য করতে পারে যাতে করে তার মানসিক সমস্যাগুলো দূরীভূত হয়। সুতরাং শিশুর বাসগৃহ ও বিদ্যালয়ের পরিবেশ যাতে মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে সহায়ক হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা ও মানসিক রোগ প্রতিরোধ সামাজিক ব্যবস্থাসমূহ যে সব সামাজিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন সেগুলো হলো 

১) শিশুর জন্য স্বাস্থ্যকর পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ গড়ে তোলা ২) শিশুর বিদ্যালয়ের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত করে গড়ে তোলা ৩) শিশুর মানসিক সুস্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য পারিবারিক অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দূর করা, সহিংসতা, দরিদ্রতা শিশুর নিরাপত্তাহীনতা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা ৪) যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতি শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে এ জন্য এ সমস্যা কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি সরকার ও জনগণের কাছে এখনো উপেক্ষিত। শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি মানুষ যতটা সচেতন মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি ঠিক ততটা সচেতন নন। মানসিক স্বাস্থ্যকে বাদ দিয়ে একজন মানুষ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারে না, কেননা শরীর ও মন একে অপরের সাথে জড়িত। তাই শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য মনোবিজ্ঞানী, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান সাইকিয়াট্রিস্ট, এনজিও, সরকার ও সচেতন জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আসতে হবে। 

*-*এ এইচ এম মনিরুজ্জোহা: সহকারী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগশেখ বোরহানুদ্দীন কলেজ, ঢাকা*-*